Thursday, October 9, 2008

রাষ্ট্র ভাষা বাংলার সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত কি ব্যার্থ?... কথ্য ভাষায় বাংলার পূর্ন ব্যবহার চাই

বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এই দেশটি যা পৃথিবীর বেশিরভাগ লোকের কাছে এখনো অজানা তার পরিচয়ের সাথে যে নামটি অঙাঅঙীভাবে জড়িত তা হলো বাংলা। বাংলার গৌরব গাথা যদি লেখা হয় তবে প্রথম গৌরবের মর্যাদা পাবে ৫২'র ভাষা আন্দোলন। বাংলাদেশের যত অর্জন তার শুরু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পাওয়া। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আমাদের প্রিয় ভাই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মত আরও অনেক ভাইকে হারিয়েছি। আদরের সন্তান, প্রিয়তম স্বামী হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়েছে এই গৌরবের মূল দাবীদারদের প্রিয়জনেরা। বাংলা আমাদের রক্তের সাথে মিশে থাকা এক অপরিহার্য পদার্থ। বাংলা আমাদের শরীরের রক্তে মিশে থাকা অনুচক্রিকার মত। শরীরের কোথাও যখন কেটে যায়, তখন অনুচক্রিকা রক্তকে জমাট বাধার ব্যবস্থা করে শরীরকে রক্ষা করে। বাংলা ভাষাও তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্রান্তি কাল ৭১এ সকল বাঙালীকে এক হতে সাহায্য করেছিল। আমরা এই ভাষাকে দিয়েই আমাদের দেশকে চিনি। আমার প্রিয় বাংলাদেশ। কবি তার সাহিত্য মাধুর্য তাই বলেছেন, "মোদের গরব, মোদের আশা, আ'মরি বাংলা ভাষা।"

বাংলাভাষার মর্যাদা ১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত আমাদের কাছে উপরোল্লিখিত অবস্থায় ছিল। ভাষা আন্দোলন মূলত ছিল শহুরে আর মফস্বলের মানুষের একটা বস্তু। আর গ্রামের মানুষজন এ সম্বন্ধে বেশি কিছু জানত না। তারপরও দেখা গেছে এখনও গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা আগে যেমন অপরিহার্য ছিল তেমনি আজও আছে। কিন্তু আজ আমরা শহুরে আর মফস্বলের মানুষজনের কাছে বাংলা ভাষা এখন আর রক্তে মিশে থাকা অনুচক্রিকা নয়, বরং আমরা বাংলাকে এখন রক্তের একটা অপ্রয়োজনীয় জীবাণুর মর্যাদা দিয়ে থাকি। কিভাবে তা বর্ণনা করার অবকাশ রাখে না, তারপরও একটু চেষ্টা করে দেখি।

১. শহরের বর্তমান শিক্ষিত সম্প্রদায় তাদের সন্তানকে ঘুমাতে যাবার সময় "গুড নাইট", এবং ঘুম থেকে উঠে "গুড মর্নিং বলা শেখায়।

২. আমরা আগে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতাম গোসলখানা অথবা পুকুরঘাটে গিয়ে, এখন টুথব্রাশ করি টয়লেটে কিংবা বাথরুমে গিয়ে।

৩. আগের কাপড় ধোয়া এখন কাপড় ওয়াশ করা আমাদের দৈনন্দিন একটা কাজ।

৪. আমরা ব্যাবসা বলতে ছোট কারবার বুঝি, আর বিজনেস বললে বড় পুঁজির কারবার বুঝি। আগে অনেকে চাকুরী করত, কিন্তু এখন সবাই সার্ভিস করে।

৫. আমরা কাউকে ফোন নাম্বার দেবার সময় কখনো বাংলা কথায় সংখ্যা উচ্চারন করি না। কখনো বলি না যে আমার নাম্বার হলো, শুন্য এক সাত নয়...., বরং বলিযে, জিরো ওয়ান সেভেন নাইন....। ফোনে কথার শুরুতে ইংরেজিতে হ্যালো তো আছেই...।

৬. আমরা দুপুরের খাবার এখন আর খাই না। তবে লান্চ করি। ব্রেকফাস্টও এখন সকালের নাস্তার বদলে করে থাকি।

৭. টিভিতে আলোচনা অনুষ্ঠান এখন টক শো তে গিয়ে পৌছে গেছে। আর বাংলা চ্যানেলের বাংলা টক শো গুলোতে বাংলাকে সম্মান করে একটু একটু বাংলা বলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, বাকি টুকু ইংরেজীতেই চালানো হয়। ভাব দেখলে মনে হয় বাংলায় কথা বললে আমন্ত্রিত অতিথিকে কেউ হয়তো কম শিক্ষিত ভাবতে পারে। আর উপস্থাপনাও হয়ে থাকে আধা ইংরেজীতে আর ইংরেজীর মত করে বলা বাংলায়।

৮. এখন আবার নতুন আমদানি হয়েছে ডিজুস ল্যাংগুয়েজের। আর পাশাপাশি আছে বাংলা সংস্কৃতির বিকৃত রূপ। তা হলো উচু মাত্রায় এডিটেড বাংলা গান যেখানে বাংলিশ Rap এর সংযোজন। এই গানগুলোর জন্য ভাল শিল্পিদের প্রকৃত সম্মান করা যাচ্ছে না।

৯. ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সন্তানকে পড়ানোর প্রবণতা এখন বাবা মাদের বেড়ে গেছে। এরা সন্তানকে ইংরেজী স্কুলে পড়ানোর কারনে সন্তানদের বাংলার দক্ষতা অনেক কমে যায়। অনেক পরিবারে দেখা যায় সন্তানের সাথে বাবা মা বাসায়ও ইংরেজিতে কথা বলে।

১০. বাংলা চলচিত্রের মান দিন দিন অবনতি ঘটায় সকল বয়সের মানুষের কাছে হিন্দি মুভি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর উর্দু ভাষা হিন্দির তুলনায় শ্রুতিমধুর হওয়ায় ভারতীয় চলচিত্রে উর্দুর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। তাদের গানের কথাগুলো হয় উর্দু। আর বাংলাদেশে হিন্দি গান তথা উর্দু গান অপেক্ষাকৃত বেশী জনপ্রিয়। আর কথায় কথায় আমরা অনেকেই কথায় কথায় উর্দু বলার চেষ্টা করি। উর্দুকে যদি কথ্য ভাষায় যোগ করার চেষ্টা করি তবে উর্দু থেকে বাচার জন্য কেন রফিক জব্বার বাংলার জন্য জীবন দিলেন?

তবে কি বলতে হবে আমরা অযথাই বাংলার জন্য জীবন দিয়েছি? অযথাই দেশকে স্বাধীন করেছি? আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষনার কোন প্রয়োজন ছিলনা?

অবশ্যই না। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা ছিল, আজ আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যদিও কোন লক্ষনই দেখা যাচ্ছে না। তবে আমরা খুব বেশি সরে যাইনি। এখনো যদি উদ্যোগ নেয়া হয় তবে বাংলাকে তার পুরোনো মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া যাবে। তাই আমার কম বুদ্ধির মাথা থেকে বের হওয়া কিছু প্রস্তাবনা আছে। আর আপনাদের সাহায্যও প্রয়োজন।

প্রস্তাবনা:
১. আমরা লেখাপড়া ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে যদিও ইংরেজী ব্যবহার করাটা অপরিহার্য, কিন্তু দৈনন্দিন কথ্য ভাষায় বাংলার ব্যাবহারে কোন বাধা নেই। তাই আমরা যদি একটু চেষ্টা করি তাহলে হয়তো বাসায় সকলে বাংলার পূর্ন ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব।

২. মজার কথা হলো আমি নিজেও প্রায় তিন বছর পর বাংলায় লিখতে গিয়ে খেয়াল করলাম হাত দিয়ে কলম চলছেই না। আমার মনে আছে আমি হাতের লেখায় স্কুলে সেকেন্ড ছিলাম। কিন্তু এখন লিখতেই পারছি না। তাই ইউনিভার্সিটি গুলোতে বাংলার কিছু কিছু ব্যাবহারের ব্যাবস্থা করা উচিত।

৩. টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে একশ ভাগ বাংলা ব্যাবহার করে অনুষ্ঠান তৈরীর ব্যবস্থা করা উচিত। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নয় মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সারা বছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করা।

৪. তরুন প্রজন্মের কাছে বাংলাকে ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী করার জন্য স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটি লেভেলে বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করা।

৫. বাংলা চলচিত্রের উন্নয়ন তথা অশ্লীলতামুক্ত উচ্চ শিল্পমানের শিক্ষামূলক চলচিত্র নির্মান করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া।
ইত্যাদি।

এ-ই শেষ নয়। অনেক কাজ বাকি। সবাইকে একসাথে আবেগ দিয়ে নয় বাস্তব ভিত্তিক ভাবে কাজ করতে হবে। সামহোয়ারইনব্লগকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই তাদের বাংলা চর্চার উৎসাহপূর্ণ ওয়েবসাইটের জন্য। ভাল বাংলা লেখক ও পাঠক সৃষ্টিতে এটি সত্যিই ভাল ভুমিকা রাখছে।

No comments: