আমরা যে এ রাজ্যের রাজার মতই...
১০ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:৪৯
একটা রাজ্য ছিল কিন্তু তার কোন রাজা ছিল না। কেউ রাজ্যের রাজা হতে চায়না। জনগন মাথায় হাত দিয়ে দিনের পর দিন একজন রাজার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। কিন্তু কোন পথচারীই জনগনের শর্ত মেনে রাজা হবার আগ্রহ প্রকাশ করতে চায়না, আর রাজ্যের লোকতো নয়ই।
এ রাজ্যের রাজা হতে গেলে শুধু একটা শর্ত মাথা পেতে নিতে হত। তা হল ঠিক পাঁচ বছর পর রাজাকে রাজ্যের সবচেয়ে দূর্গম এলাকায় নির্বাসনে যেতে হবে। সে দুর্গম স্থানটি এতই অবাসযোগ্য যে এখানে নেই কোন খাবার অথবা পানি। আর এই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজ্যের সবচেয়ে কাছের ভাল কোন স্থানেও পৌছানো সহজ নয়। এ পর্যন্ত যত রাজাই নির্বাসনে গিয়েছেন, তাঁদের কাউকেই আর জনপদে দেখা যায়নি, বরং প্রতিবার ওখানে কোন রাজাকে নির্বাসনে পাঠানোর সময় ওখানে নতুন একখানা মনুষ্য কঙ্কালের দেখা মিলেছে।
সে যা হোক। দেশের জনমানুষের ভাগ্যের দ্বার খুলে দিয়ে একজন অজানা যুবক পথিক হঠাৎই রাজা হতে রাজী হয়ে গেল। সবাই রাজাকে সম্মান জানালেন। দেশের সকল সম্পদ এবং আনুগত্য সেই রাজার পায়ে ঢেলে দেয়া হলো। তবে এই রাজা এই সম্পদ ও আনুগত্যে আগের রাজাদের মত আনন্দ ও গৌরবে আত্নহারা হয়ে গেলেননা। বরং প্রথম বেশ কয়েক রাততো একবারের জন্য এক করতে পারলেননা। তিনি পাঁচ বছর পরের দুর্দশার কথা ভাবতে লাগলেন আর কাঁদতে লাগলেন। আর দিনরাত ভাবতে লাগলেন এ বিপদ থেকে বাঁচতে হলে কি করা যায়। পেয়েও গেলেন একটা কঠিন উপায়। আর সংগে সংগেই মাঠে নেমে গেলেন। তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন দ্রব্যাদি উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানোর তাগিদ দিতে লাগলেন জনগনকে। এর জন্য তাঁর পক্ষ থেকে যত সাহায্য করা সম্ভব ছিল তার সবই করলেন। রপ্তানী আয় চরমে উঠে গেল। আর এ আয় দিয়ে তিনি রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সেবাখাতের উন্নতি করতে লাগলেন। নতুন নতুন টেকনোলজীর উদ্ভব করালেন বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে। তাঁরা সহজ চাষ পদ্ধতি ও সেচ পদ্ধতির উন্নয়ন করলেন। আর তাদিয়ে রাজা প্রত্যন্ত এলাকায়ও চাষবাসের ব্যবস্থা করলেন। নতুন নতুন জনপদ তৈরী হলো। সারারাজ্যের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসালয় স্থাপন করলেন, আরো তৈরী করলেন পাণ্থশালা। জনগন রাজ্যের রাজধানীর প্রতি অনুরক্ততা কমিয়ে, সারারাজ্যে ভাগ্যের উন্নয়নে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সবস্থানেই নগরায়ন তরান্বীত হল। আর এতসব করতে গিয়ে রাজা তাঁর যত যোগ্যতা তার সব ঢেলে দিলেন। এজন্যে তিনি কখনোই দুঘন্টার বেশি ঘুমুতে পারতেননা। নির্ঘুম রাত্রিযাপনের কারনে তাঁর চোখের নিচে কালি পড়েছে, শরীর হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। আর এর মধ্যে কখন যে পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি।
পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ। রাজ্যের জনগন সব রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। রাজ্যের নতুন জনপদগুলো থেকে সবাই রাজধানীতে এসে জমায়েত করল। তারপর রাজাকে সসম্মানে গদি থেকে নামানো হলো। বিশাল ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান শেষে তাঁকে আগের রাজাদের মত নির্ধারিত স্থানে নির্বাসনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। যাত্রাপথেই বেশ কয়েকটা নতুন জনপদে তাঁকে বিদায় জানানো হল।
গন্তব্যে পৌছানোর পর সবাই তাজ্জব হয়ে গেল। একি!! এ জায়গাতো আর আগের সেই বিরানভূমি নেই। রাজ্যের সবচেয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের পরিশ্রমের মাধ্যমে রাজ্যের সবচেয়ে দূর্গম এ স্থানটি এক বিশাল জনপদে পরিণত হয়ে গেছে। সুজলা আর সুফলা হয়ে গেছে। নেই খাবারের অভাব, কিংবা পানির অভাব। এখানকার মানুষজন আগে থেকেই সাবেক রাজার জন্য ভালবেসে একটা প্রাসাদ তৈরী করে রেখেছে। এখানে রাজা চাইলে সুখে সাচ্ছন্দেই বিয়ে শাদী করে জীবনের বাকিটা সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন।
রাজার এই দুরদৃষ্টি দেখে রাজ্যবাসী এরকম যোগ্য শাষকের শাষন থেকে মুক্ত হতে চাইলেননা। তাঁকে আজীবনের জন্য রাজা বানিয়ে রাজধানীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমাদের জীবনটাও এরকমই একরাজ্য, যা কিছুদিনের জন্য রাজত্ব করার জন্য অদৃশ্য থেকে আমরা আদিষ্ট হয়েছি। তারপর একদিন মৃত্যুর করাল গ্রাসে মিলিয়ে যাব অনন্তে। যেখানে থাকবে শুধু এ জীবনের কর্মফল।
(সংগৃহীত ও পরিমার্জিত)
No comments:
Post a Comment