অবশেষে বিশ্বের শেষ জীবিত মানুষটিকেও হারাতে হল। ও একজন নারী ছিল। আজ সকালেই মারা গেছে সে। দেড় বছর ধরেই একে বাঁচিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীর বংশধারাকে রক্ষার জন্য এ নারীটির জন্য একজন পুরুষ খোঁজা হচ্ছিল, কিন্তু ডাটাবেজে পুরুষের সংখ্যা আরো বিশ বছর আগে থেকেই শুন্য। নারীর সংখ্যাও তের হতে ধীরে ধীরে আজ শুন্যে পরিণত হল। আজ হতে পৃথিবীতে মানুষের রাজত্ব শেষ। শুরু হল অনুভূতিহীন একদল শ্রমিকের রাজত্ব। মানুষের হাতেগড়া রোবটই এখন এ পৃথিবীতে সর্বেসর্বা।
অনেক প্রাচীন আমলের কথা। তখন পৃথিবী ছিল সুজলা সুফলা। মানুষ কতই না সুখে শান্তিতে বসবাস করত সেখানে। হয়ত কোন বিলাসিতার সুযোগ ছিলনা তাদের, ছিলনা উন্নত যোগাযোগ কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থা। সুচিকিৎসার অভাব ছিল কিন্তু প্রকৃতি মানুষকে আগলে রাখত নবজাতক শিশুর মত করে। ধীরে ধীরে মানুষ নিজেদের উন্নতি করতে লাগল। জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি করতে করতে শীর্ষে পৌছে গেল। তারা যতই বিজ্ঞানে উন্নত হতে থাকল, তাদের মনুষ্যত্ব ততই ধীরে ধীরে কমতে লাগল। তারা নির্বিচারে তাদের মায়ের মত প্রকৃতিকে নষ্ট করল। গাছ কেটে সাফ করে ফেলল। পরিবহন আর ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের নামে বায়ুমন্ডলকে ধোঁয়া দিয়ে ছেয়ে দিল। উৎপাদনের নামে পানিতে বিষ মিশিয়ে দিল। সম্পদ-ক্ষমতার লোভ মেটাতে শান্তির নামে হত্যা করতে থাকল স্বজাতি মানুষকে। প্রকৃতিও নিষ্ঠূর হতে বাধ্য হল। হুমকি দিল এ মানুষের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে।
২০০৯ এর শেষের দিকে কোপেনহেগেনে বিরাট এক সম্মেলন হয়েছিল। সবার ধারনা ছিল, এবার বোধহয় পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব বাচানোর ব্যপারে কোন সমাধানে আসা যাবে। কিন্তু না, সে সম্মেলন পৃথিবীর ভবিষ্যত অনেকটাই নিশ্চিত ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বকে ঠকিয়ে উন্নত বিশ্ব নিজেরাই নিজেদের বিপদকে এগিয়ে নিয়ে এল। তৃতীয় বিশ্বকে হয়ত একটু আগেই পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন হতে হয়েছে, কিন্তু উন্নত বিশ্বও বাঁচতে পারেনি প্রকৃতির প্রতিশোধের হাত থেকে। উন্নত বিশ্বও জানত তারাও প্রকৃতির কোপানলে পড়তে যাচ্ছে, তাই তারা নতুন পরিকল্পনা গ্রহন করে বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
প্রকৃতির প্রতিশোধ হতে বাঁচতে মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বেশি বাড়িয়ে দিল। বাসগৃহের ভেতরের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রনের জন্য আরো আধুনিক বায়ুনিয়ন্ত্রন যন্ত্র নির্মান করা হল। বায়ু পরিশোধনের যন্ত্রও আবিষ্কার করা হল, যা গৃহের বায়ুকে পরিশোধিত করলেও, বাইরের বায়ুকে আরো বেশি মাত্রায় দূষিত করে। নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা আরো উন্নত ও সহজে ব্যবহারযোগ্য করা হল। সারা বিশ্বের সব মানুষের তথ্য একটা ডাটাবেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হল। সারা বিশ্বের মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার জন্যে সেই ডাটাবেজের নিয়ন্ত্রন রাখল আমেরিকার সরকার। তারা সারা বিশ্বের সকল মানুষের কাজকর্ম এবং যে কোন সময়ের অবস্থান জানতে পারল মাউসের মাত্র একটা টিপের মাধ্যমে। ভার্চুয়াল অফিস ব্যবস্থা তৈরী করা হল। যার ফলে, মানুষ ঘরের বাইরে না গিয়েও তার অফিসের কাজকর্ম করতে পারে। ধীরে ধীরে অফিস আদালত সব বন্ধ হয়ে গেল, ভার্চুয়াল জগতের ভার্চুয়াল অফিসে নিয়মিত কার্যক্রম চলতে থাকল। পরিবহন ও অন্যান্য শ্রমের জন্য বিপুল পরিমান রোবট তৈরী করা হল। রোবট শ্রমিকরা দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমকে চালিয়ে নিতে থাকল।
২০৬০ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বের হাতে কয়েক কোটি রোবট আর ভার্চুয়াল অফিসিয়াল সিস্টেমের সুফল আসতে থাকল। ততদিনে পৃথিবীর আবহাওয়া সাধারন মানুষের বসবাসের অযোগ্যতায় পরিপূর্ন হল অনেকখানি। গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া উন্নত বিশ্বের খায়েশ মেটাতে গিয়ে প্রচন্ড বেড়ে গেল। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল হুড়মুড় করে। দক্ষন আর উত্তর মেরুর বরফ গলে অর্ধেকে নেমে গেল। দক্ষিন এশিয়াসহ নিচু ভূমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেল। আন্ত:দেশীয় দন্দ্ব আর হিংসার কোপানলে পড়ে প্লাবিত দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়ে ডুবে মরল। আর যারা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে স্থান পেল, তাদেরকেও না খেয়ে মরতে হল। কৃষির উপর জোর কম দেয়ায়, উন্নত বিশ্ব ভূমিহীনদের জন্য তেমন কোন সাহায্যই করতে পারলনা।
উন্নত বিশ্বের নারীগন সন্তানগ্রহনে তেমন আগ্রহী নয়। অপরদিকে ভারত সহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মানুষ তাদের সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদেরকে এ প্রতিকূল পৃথিবীতে আসতে দিলনা। ফলে আর মাত্র একশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এল। এদিকে পরিবেশ বিপর্যয় কিন্তু থেমে থাকলনা। উন্নত বিশ্বের মানুষকে আরামে রাখতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদ্গীরন বেড়েই চলল। আরো একশ বছরের মধ্যেই বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর বলে আর কিছুই থাকল না। অতিবেগুনী রশ্মী আর সূর্যের প্রলয়ংকরী বিভিন্ন আলো পৃথিবীকে আলোকিত করার পাশাপাশি অন্ধকারের ডোবায় নিক্ষেপ করল। বাইরে বেরুলেই ক্যন্সার এমন একটা অবস্থা তৈরী হল। যাদেরকে বাধ্য হয়ে ঘরের বাইরে যেতে হল, তাদের সবাইকেই ভয়াবহ এই রোগে আক্রান্ত হতে হল। কোটি কোটি মানুষ শুধু চামড়া ক্যন্সারেই মারা গেল। দক্ষিন আর উত্তর মেরুতে বরফ বলে কিছুই থাকলনা, ফলে প্লাবিত হল আরো অনেক ভূমি। এভাবেও ধ্বংশ হল অনেক জাতি। উন্নত বিশ্বের আরামের জন্য নিয়োজিত বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স বিলাস দ্রব্য উৎপাদন কারখানার বর্জ্যগুলো এতই ভয়ংকর ছিল তা মাটি এবং সাগর-নদীল পানির সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ পানিকেও নষ্ট করে দিল। ফলে রোবট কৃষকের ফলানো ফসল এবং আধুনিক স্বয়ংক্রিয় জেলে জাহাজের ধরা মাছগুলোও বিষক্রিয়ার ফলে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে গেল। আমেরিকার ডাটাবেজে যখন জীবিত মানুষ হিসেবে শুধু উন্নত বিশ্বের মানুষের তালিকা, তখন সে তালিকাও হঠাৎ করে খুব দ্রুত ছোট হতে লাগল। হাতেগোনা যে কয়জন বিজ্ঞানী বেচে ছিলেন তারা বিষক্রিয়া নিয়ন্ত্রনের যন্ত্র বানালেও, কিছুদিনের মধ্যেই ফসলের বিষক্রিয়ার মাত্রা এ যন্ত্রের ক্ষমতার বাইরে চলে গেল।
২২৫০ সাল। আমেরিকার ডাটাবেজে জীবিত মানুষের সংখ্যা মাত্র তের লক্ষ। এদের সবাইই আমেরিকা আর ইউরোপের সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের লোকজন। আরেকটা ডাটাবেজে সারাবিশ্বে নিয়োজিত রোবটের তালিকা। এদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবী ভ্রমনে বের হবেন। পৃথিবী আজ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে, এ অবস্থা হতে বাঁচবার কোন উপায় আছে কিনা তা তিনি সরেজমিনে দেখবেন। গত দুশ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস হতে বেরুচ্ছেন। একটা সুনিয়ন্ত্রিত উড়োজাহাজে করে তিনি আকাশের অনেক নিচু হয়ে ধীরে ধীরে উড়ে পৃথিবী পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন। ইউরোপ, আমেরিকা আর আফ্রিকার কিছু অংশ এখনো তলিয়ে যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ছোট্ট একটা প্রবাল দ্বীপে পরিণত হয়ে টিকে থাকলেও সেখানে কোন মানুষ নেই। এন্টার্কটিকার দিকে যাওয়ার চিন্তা মাথায়ও আনলেন না মি: প্রেসিডেন্ট। আফ্রিকায় কেউই রোগবালাই জয় করে টিকে থাকতে পারেনি। সেখানকার সব স্থাপনা স্থবির হয়ে গেছে। প্রত্নতাত্নিক নিদর্শনে পরিণত হয়ে গেছে সবকিছুই। এখানে ওখানে মানুষের হাড় পড়ে আছে।
আমেরিকা আর ইউরোপকে দেখে মি: প্রেসিডেন্ট অনেকটাই স্বস্তিবোধ করলেন। সেখানে এখনো জীবনের ছায়া পাওয়া যায় ভেবে গর্বিত হলেন। তিনি দেখলেন আটলান্টিকে স্বয়ংক্রিয় অসংখ্য মাছধরা জাহাজ মাছ ধরে যাচ্ছে। জাহাজ ভরে গেলে তা ফিরে আসছে বন্দরে। বন্দরের স্বয়ংক্রিয় ক্রেন মেশিনগুলো সে মাছগুলোকে জাহাজ হতে আনলোড করছে অতিদ্রুততার সাথে। সে মাছগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত লরিগুলো বহন করে নিয়ে যাচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে। সেখানকার স্বয়ংক্রিয় রোবটগুলো সে মাছকে প্রক্রিয়াজাত করে পাঠিয়ে দিচ্ছে হিমাগারে। হিমাগারে নিয়োজিত রোবটগুলো অনলাইনে পাওয়া অর্ডারগুলোকে জায়গামত পাঠিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট কাভার্ড ভ্যানে করে। অর্ডারের পরিমান উৎপাদনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায়, উৎপাদিত মাছ সংরক্ষনের জন্যে নতুন নতুন হিমাগার তৈরী করা হচ্ছে। নির্মানকাজে নিয়োজিত অসংখ্য রোবট হিমাগারসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে নিরবে। অথচ এত উৎপাদনের আর কোন দরকার নাই। বিদ্যুত আর অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ঠিক করার দায়িত্ব পালন করছে আরেকদল ইলেক্ট্রিশিয়ান রোবট। তারা গোটা জীবিত অঞ্চলসহ মৃত অঞ্চলেও দায়িত্ব পালন করছে নিরবে। তাদের বোঝার কোন ক্ষমতা নেই যে, মৃত অঞ্চলে এর আর কোন দরকার নেই। কৃষি হতে শুরু করে সব স্তরেই কাজ করে যাচ্ছে এমন প্রায় তিনকোটি রোবট। মি: প্রেসিডেন্ট
No comments:
Post a Comment