মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সটির সীরাতুন্নবী (স:) পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত নির্ধারিত বক্তব্য প্রতিযোগীতায় উপস্থিত সম্মানিত শিক্ষক ও সহপাঠী বন্ধুরা, আসসালামু আলাইকুম। আজকের প্রতিযোগীতার বিষয় নির্ধারন করা হয়েছে “আদর্শ যুবসমাজ গঠনে মহানবী (স:) এর ভূমিকা”।
আজ থেকে প্রায় দেড় সহস্র বছর আগের আরব ছিল পুরোপুরি শাষনের অযোগ্য। তাদের সভ্যতা ছিল তৎকালীন সকল সভ্যতার তুলনায় বর্বর। পুরো আরব অসংখ্য গোত্রে গোত্রে বিভক্ত ছিল। এই গোত্রগুলো একে অপরের সাথে সারাবছরই যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। একে অপরের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অকাতরে রক্ত ঝরাত। আর এসব যুদ্ধে সবচে বেশি হিংস্রতার এবং জিঘাংসার উদাহরন তৈরী করত ঐ সকল গোত্রের যুবকেরা। নারীরা সেসব যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও তারা পেছন থেকে অনুপ্রেরনা দিত। সমাজের কবি সাহিত্যিকরাও উত্তাল রক্তের যুবকদেরকে প্রতিশোধ গ্রহনের প্রতি বাসনাকে উস্কে দিত। আর এই যুদ্ধের জের ধরে নিষিদ্ধ কয়েকটি মাস ছাড়া বাকি সব সময়ই হত্যা ও সম্পদ বিনাস চলতে থাকত। শক্তিশালীদের হাতে প্রতিনিয়ত লুন্ঠিত হত দুর্বলের সম্পদ। মদ ও জুয়া ছিল যুবকসহ সকল বয়সের মানুষের নিত্য সঙ্গী। তৎকালীন সুপারপাওয়ার ইরান এবং রোমান সম্রাজ্য কখনোই এই উচ্ছৃংখল আরবদের শাষন করার দু:স্বপ্ন ভুলেও দেখতনা। তাদের মতে, আরবদের কাছ থেকে ভাল কিছুই আশা করা সম্ভব নয়।
সামান্য কারনেও যেই আরব গোত্রীয় কোন্দলে মুখর হয়ে যেত, যুবকের দল রক্তপিপাসু হয়ে যেত সেই আরবে ৫৭০ খ্রীস্টাব্দে জন্ম নিল এক শিশু। তাঁর নাম রাখা হল মুহম্মদ। তিনিই আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ হযরত মুহম্মদ (স)।
মুহম্মদ (স) এর জীবনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে নবুওয়াত লাভের পূর্বের অংশ এবং অপরটি হচ্ছে নবুওয়াত লাভের পরের অংশ। আদর্শ যুবসমাজ গঠনে জন্য তাঁর জীবনের এ দুটি অংশেই তিনি ভূমিকা রেখে গিয়েছেন।
পরিশ্রমী মুহম্মদ (স)
নবুওয়াতের পূর্বের জীবনকে খতিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই তিনি শৈশব থেকেই অত্যন্ত পরিশ্রমী জীবন যাপন করেছেন। দুধমা হালীমার কাছে থাকতে তিনি মাঠে মেষ চড়াতেন। চাচা আবু তালিবের কাছে অবস্থানকালেও তিনি মেষ চড়াতেন এবং চাচার ব্যবসায়ে সাহায্য করতেন। তিনি চাচার সাথে বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায়ও গিয়েছিলেন। আর যুবক বয়সে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
সততা ও নিষ্ঠা
মুহম্মদ (স) এর সততা ও নিষ্ঠা এ দুয়ের সমন্বয় সেই আরব সমাজে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। সেই আরব সমাজের মানুষ বেশিরভাগ সময়ই মিথ্যের মাধ্যমে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করত। ওজনে কম দেয়া, জিনিস পত্রে ভেজাল দেয়া, আমানত এর খেয়ানত করা ইত্যাদি সেখানকার ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের জন্যই নিয়মিত ব্যপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে মুহম্মদ (স) সে সমাজে আমানতদারিতার ও সততার এক আলোকিত উদাহরন তৈরী করেছিলেন। এ জন্যে সকলে তাঁকে আল-আমীন বলে ডাকত এবং সবচে বেশি বিশ্বাস করত।
মানবতাপ্রেমের দৃষ্টান্ত
নবুওয়াত লাভের আগ থেকেই তাঁর মাঝে মানবতার প্রতি প্রেমের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। আরবের যুবকেরা যখন প্রতিপক্ষ গোত্রের মানুষের রক্ত ঝরানোর উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করত, তখন মুহম্মদ (স) যুবক হয়েও তা না করে বরং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরীর চেষ্টা করেছেন। এজন্যে তিনি কিশোর বয়সেই সমবয়সীদের নিয়ে হিলফুল ফুযুল নামে একটি সংঘও গড়ে তুলেছিলেন । কাবা ঘরের হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে তৈরি হতে যাওয়া গোত্রীয় সংঘাত তিনি খুব সফলভাবে সমাধান করেছিলেন। তৎকালীন আরবে দাসপ্রথা চালু ছিল। দাসদের সাথে খুব দুর্ব্যবহার করা হত। অথচ মুহম্মদ (স) দাসদের সাথে খুব মধুর আচরন করতেন। তাঁর এক দাস যায়েদ বিন হারেস (রা) কে তিনি নিজের পালক পুত্র বলে গ্রহনও করেছিলেন।
নবুওয়াত পরবর্তী অবদান
মুহম্মদ (স) ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করলেন। শান্তির বাহকে পরিণত হলেন আরবের এ যুবক। ধারাবাহিকভাবে শান্তির বানী পৌছে দিলেন সবার দ্বারে দ্বারে। প্রথমে মক্কার অল্প কজন তাঁর দাওয়াত গ্রহন করল। ইসলাম প্রচারের অপরাধেই আরবের সকলের চোখের মণি মুহম্মদ পরিণত হলেন চোখের কাটায়। একের পর এক নতুন নতুন অত্যাচার আসতে থাকল তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের উপর। অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সকল অত্যাচার মাথা পেতে নিয়ে গুটিকয়েক মুসলিমকে নিয়ে তিনি তাঁর দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। মদ-জুয়া আর রক্তে মাতাল আরবের যুবসমাজ পরিণত হল পৃথিবীর শান্তি প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসেবে। আওস-খাযরাজের চির সংঘর্ষের ভূমি ইয়াসরিবকে পরিণত করলেন শান্তির কেন্দ্রভূমি মদিনাতুল নববীতে। মক্কা বিজয়ের পর অত্যাচারী কাফেরদের তিনি ক্ষমা করে দিয়ে তৈরী করলেন বিজয়ীদের জন্য এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
আরবের যুবসমাজকে তিনি পরিবর্তন করে নিতে পেরেছিলেন। তিনি এমন এক যুব সমাজ তৈরী করেছিলেন যা সারা বিশ্বের যুবকদের জন্যই আজ এক আদর্শ। তিনি আবু বকর সিদ্দিক (রা), হযরত আলী (রা), ওমর (রা), ওসমান (রা) সহ অসংখ্য যুবককে শ্রেষ্ঠ্ মানুষে পরিণত করেছিলেন। শাষনের অযোগ্য আরবের যুবকদেরকে পরিণত করেছিলেন সারা বিশ্বের যোগ্য শাষকে।
আজকের যুবসমাজও ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বিষাক্ত জিনিসগুলোর চাকচিক্য মরিচীকা হয়ে তাদেরকে ধীরে ধীরে ধ্বংশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মক্ষমতাকে প্রবাহিত করা হচ্ছে বিপথে। প্রভাবশালী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো এখন প্রকাশ্যেই যুবকদেরকে আহবান করে এই বলে যে, “বন্ধু – আড্ডা আর গানে হারিয়ে যাও”। সত্যিই হারিয়ে যেতে বসেছে আজকের যুবসমাজ। এই যুবসমাজকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন প্রিয় রাসূল (স) এর শিক্ষার বাস্তব চর্চার। তিনি তাঁর পুরো জীবনে উদাহরনের মাধ্যমে যা যা শিখিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, আমানতদারীতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং ধৈর্য ইত্যাদি সকল সৎ গুনাবলি। এ গুনাবলি অর্জনের জন্য তিনি দুটো জিনিস রেখে গেছেন। সেদুটো জিনিস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। আমরা যুবকরা যদি এদুটো উৎস হতে যথাযথ জ্ঞানার্জন করে রাসুলুল্লাহ (স) এর সৎগুনাবলী গুলো অর্জন করতে পারি তবে আমরা আবারও পরিণত হতে পারব সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে।
ধন্যবাদ সবাইকে
No comments:
Post a Comment