বিংশ শতাব্দির ত্রিশের দশক। তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাষনের শেষ যূগ চলছিল। প্রায় তিরিশ কোটি জনসংখ্যার ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগন্য। শুধু সংখ্যায়ই নয়, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেও মুসলমানদের অবস্থান পৌছে গিয়েছিল সমাজের সর্ব নিম্ন স্তরে। জমিদার বাড়ির দফতর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যেকটি গুরুত্বপুর্ন পদ যেমন, মোড়ল-মাতব্বরি সবই ছিল হিন্দুদের দখলে। যদিও ভারতবর্ষের এদিকটায় মানে বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, কিন্তু প্রভাব প্রতিপত্তিতে সবখানে হিন্দুদের দাপটই ছিল সবচে বেশি।
সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর গোত্রভেদ এবং অহংকার ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তাদের নিজেদের মধ্যেই জাত নিয়ে প্রচন্ড দ্বিধাবিভক্তি ছিল, উঁচু জাতের মানুষ নিচু জাতের ছায়া মাড়াতেও পছন্দ করত না। আর মুসলমানদেরকে তারা তাদের সবচে নিচু জাতের চেয়েও খারাপ চোখে দেখত। হিন্দুদের বাড়িতে মুসলমানদেরকে কখনোই চেয়ারে বসতে দেবার রেওয়াজ ছিল না। এমনকি তাকে পিঁড়ি কিংবা চট এগিয়ে দিয়ে বসতেও বলা হত না। বরং প্রয়োজনে হিন্দু গেরস্ত হয়ত মুসলমান অতিথিকে অনেকটা আদেশের ভঙ্গীতেই পাশ থেকে চট বা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসতে বলতেন। শুধু যে অবস্থাপন্ন হিন্দু পরিবার দরিদ্র মুসলমানের সাথে এ ধরনের আচরন করত তা নয়, বরং প্রত্যেক হিন্দু পরিবারই অপেক্ষাকৃত ধনী মুসলমান অতিথিদের সাথেও এধরনের আচরনে অভ্যস্ত ছিল।
জমিদার বাড়িতে কিংবা গুরুত্বপুর্ন সরকারী পদ এবং গ্রামের মাতবর শ্রেনীর পদবীগুলোর পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবেও প্রাধান্য বেশি পেতেন হিন্দুগন। এবং এসব হিন্দু শিক্ষকগনও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ পছন্দ করতেন। তাঁরা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্যে শ্রেনীকক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বসার স্থান নির্ধারন করে দিতেন। কেউ কেউ আবার মুসলিমদের জন্যে কেবল শ্রেণীকক্ষের একদম পেছনের বেণ্চগুলো নির্ধারন করে দিতেন। শুধু শ্রেনীকক্ষে বসার স্থানের ব্যাপারেই নয়, বিদ্যালয়ে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হত সংখ্যালঘু মুসলিম শিক্ষার্থিদের।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান (সাবেক অধ্যাপক, বাঙলা বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি) তাঁর ছেলেবেলার একটা ঘটনার কথা বললেন। উল্লেখ্য উনার জন্ম সেই তিরিশের দশকেই। তিনি কোন একদিন বিদ্যালয় থেকে তাঁর সহপাঠিদের সাথে একসাথে বাড়ি ফেরার পথে ঘটনাক্রমে হিন্দু জমিদারের কলাগাছ থেকে একটা কলা ছিড়েছিলেন। কেমন করে যেন সেই খবর চলে গেল জমিদারের কাছে। সেদিনই হিন্দু জমিদার তার লোকজন পাঠিয়ে মুসলমানের ছেলের হাতের ছোঁয়া লাগা গাছটিকে উপড়ে ফেলে দিলেন। সেই সময়কার হিন্দু মহল এতটাই ঘৃণা করতেন মুসলমানদের।
বৈষম্যের হাত থেকে বাঁচতেই মুসলিম নের্তৃবৃন্দ বহুবার দাবী তুলেছিলেন একটি সম্পুর্ণ আলাদা মুসলমান প্রধান ভূমির জন্যে। এ দাবীর ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ হলেও পরে তা শক্তিশালী হিন্দু নের্তৃত্বের প্রভাবে রদ হয়ে গেল। আমরা মুসলিমরা পিছিয়ে ছিলাম, পিছিয়েই রইলাম। ব্রিটিষ শাষিত ভারতে সবচে ক্ষতিগ্রস্ত এবঙ বৈষম্যের শিকার হয়েছিল মুসলিমগন। আর তাই ব্রিটিষ বিরোধী আন্দোলনে যতটা না ভূমিকা রেখেছে হিন্দুগন, তারচে বেশি ভূমিকা ছিল মুসলমানদেরই। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিষরা ভারত ছাড়তে রাজী হল। এবং তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্রেও রাজী হল। প্রথম দিকে লাহোর প্রস্তাবে হিন্দুপ্রধান ও মুসলিম প্রধান দুধরনের রাষ্ট্রের আলোচনায় অপেক্ষাকৃত বেশি মুসলিমের ভূমি বাংলাকে সম্পুর্ন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেবার কথা হলেও ব্রিটিষরা কিছুতেই রাজী হলনা। আবার জওহরলাল নেহেরুদের এক অখন্ড ভারতের দাবীও ব্রিটিষ সরকার মেনে নেয়নি। এর প্রেক্ষিতে তৈরী হল ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের।
ভারত কখনোই পাকিস্তানের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি, এবং হিন্দু নের্তৃবৃন্দ এই ভারত বিভাগকে একটি সাময়িক সমাধান বলে আখ্যায়িত করে এবং সেই সাথে তারা তখন আশা পোষন করেছিল যে, অচিরেই তা আবার অখন্ড ভারতে রুপান্তর হবে। তারা কেবল আশা পোষন করেই থেমে থাকেনি, বরং সেই তখন থেকেই তাদের আশাকে বাস্তবে রুপান্তর করার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে। স্থান, প্রকৃতি ও ভাষাগত মিল থাকায় পূর্ব পাকিস্তানকেই অখন্ড ভারতের স্বপ্নের সহজ টার্গেট করে ভারত। ভারতবর্ষের মুসলিমগনের পূর্ব পুরুষ ছিল ভারতীয় হিন্দুদের একই ধর্মের মানুষ। এখানকার মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি খুব বেশি পুরোনো নয়। মাত্র ১২০০ বছরের ইসলামের অনুশীলন তাদের। তাই ভারতীয় চক্র এদেশের মানুষকে তার পুরোন সংস্কৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে সবসময়ই সচেষ্ট রয়েছে। এভাবে যদি তারা বাংলার মুসলমানদেরকে ইসলামী সংস্কৃতির পরিবর্তে সনাতন ধর্মীয় সংস্কারে ফিরিয়ে নিতে পারে তবেই আর বিভক্ত রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা হারাবে। এই রকম পরিকল্পনা নিয়েই ষাটের দশক থেকেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র নিজেদের অর্থে গড়ে তুলতে থাকে ছায়ানট এবং উদীচি সহ বহু সাংস্কৃতিক সংঘ।
ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদিচী কিংবা ছায়ানট আজ যথেষ্টই সফল। আজকাল দেশে অগ্নী উপাসনা কিংবা মূর্তিপূজাকে সার্বজনীন করে ফেলা হয়েছে। এখন হিন্দু আচারগুলো ধীরে ধীরে মুসলমানদের দ্বারা অনুশীলন করানো হচ্ছে। আমরা দেখি অনুষ্ঠানের শুরুতে সনাতন ধর্মের আচার অনুযায়ী মোমবাতি জ্বালানো হয়। এমনকি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পুরনো রোমান পৌত্তলিকদের মত করে জ্বালিয়ে রাখা আছে "শিখা অনির্বাণ"। অনেক জায়গায় ধর্মীয় গ্রন্থের পরিবর্তে গান গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কপালে হিন্দুদের মত করে তীলক পরার সংস্কৃতি ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। নারীদের কপালের টিপ তো অনেক আগেই নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছে। একসময় বাংলা নববর্ষকে আমরা বরণ করে নিতাম হালখাতা কিংবা মিলাদ-মাহফিল দিয়ে আর এখন তা সার্বজনীনভাবে মূর্তি, পুতুল নিয়ে মিছিল করে গান গেয়ে বেহায়াপনা করে বরণ করি। আগে মুসলমান সাহিত্যিকের লেখা গল্প কবিতাকে সহজেই হিন্দু সাহিত্যিকদের লেখা গল্প কবিতা থেকে আলাদা করা যেত, এখন আর তা সম্ভব হয়না। মানিক বন্ধোপাধ্যায় আর মীর মোশাররফ আলীর লেখনীর পার্থক্য খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু আজকের সাহিত্যিকগনের লেখা পড়ে বোঝা মুশকিল কে যে কোন সংস্কৃতির বাহক। আজকাল মুসলিম সাহিত্যিকগনও পানিকে জল বলে সম্বোধন করেন আর খোদাকে ইশ্বর বা ভগবান কিংবা সর্বোচ্চ হয়ত স্রষ্টা বলে ডাকতে পছন্দ করেন। জাতিস্বত্বার পরিচয় ভূলিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রে তারা কতখানি সফল তা বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়। এভাবে ধীরে ধীরে মুসলিমদের জাতিস্বত্বা তিন হাজার বছরের পুরোন বাঙালী সংস্কৃতির (যা মূলত: হিন্দু/সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতি) দ্বারা হারিয়ে যেতে বসেছে। যতই আমরা আমাদের মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি ত্যাগ করে হিন্দু সংস্কৃতিতে হারিয়ে যাব, ততই বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাবে এবং যেমনটা সিকিম এখন ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বাংলাদেশও অখন্ড ভারতের অংশে পরিণত হবার পথে এগিয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment