সীমা
ম ঈ ন উ দ্দী ন
সৌরজগত থেকে প্রায় হাজার আলোকবর্ষ দুরে সূর্যের মতই আরেকটা নক্ষত্রকে ঘিরে রয়েছে একটি সৌরজগত। সেই সৌরজগতের অনেকগুলো গ্রহের মধ্যে চকুলিয়া নামে একটি গ্রহ ছিল। সেই গ্রহে অনেক প্রানী বাস করত। "মানুষ" যেমন পৃথিবীর সকল প্রানীর মধ্যে সেরা এবং কর্তৃত্বশীল, তেমনি "চাতুর" নামে এক ধরনের প্রানী ছিল সেই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রানী। এ প্রানীর ছিল মাটিতে বিচরন করার উপযোগী পা। আবার এরা স্বাচ্ছন্দে পানির নিচে চলতে পারত। এদের দেহে ফুসফুসের পাশাপাশি ফুলকাও ছিল যা তাদেরকে পানির নিচে শ্বাস নিতে সাহায্য করত। এদের দেহে বিচিত্র ধরনের পাখনাও ছিল যা দিয়ে তারা পানিতে সাতার কাটতে পারত এবং চাইলেই যে কোন জায়গায় এর উপর ভর করে উড়ে চলে যেতে পারত। সর্বোপরি এরা ছিল “অলরাউন্ডার ইন লোকোমোশন” টাইপের প্রানী।
মহাকাশবিজ্ঞানী চাতুরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাডভাঞ্চার পছন্দ করত কিফর নামের এক চাতুর মহাকাশচারী। তাদের মহাকাশ স্টেসন টুকার হঠাতই আবিস্কার করে ফেলল যে, তাদের সৌরজগতে আরেকটি গ্রহে প্রানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। উত্তাল সমুদ্র আর সবুজ গাছের দেখা মিলেছে সেখানে। অতি শিঘ্রই সেখানে অভিযানে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অভিযান অত্যন্ত বিপদজনক বলে কিফরকেই বাছাই করা হলো। কিফরও এ অভিযানে বাছাই হওয়ায় নিজেকে গর্বিত অনুভব করল, সেই সাথে অর্থনৈতিক লাভের আশায় আনন্দিত হলো। মাত্র একমাসের প্রস্তুতির পর পুরোনো কিন্তু বেশ শক্তিশালি একটা যানে করে সে রওনা দিল।
কিফর তার মহাকাশযানের ব্যাপারে খুবই আশ্বস্ত। যানটা পুরোন হলেও এমনভাবে তৈরী হয়েছে যেটি বিজ্ঞানীদের মতে মহাকাশে কিছুতেই ধ্বংশ হতে পারেনা। এ যানের শক্তিশালি ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক তাকে সূর্য নামক নক্ষত্রের কাছ থেকেও চকুলিয়া পর্যন্ত যোগাযোগে সহায়তা করতে পারবে। কোন গ্রহের অভিকর্ষ বলই এ যানকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারবেনা, ফলে বিপদের সম্ভাবনাই নেই। মহাকাশে পৌছে কিফর প্রায় দুমাসের পথ অতিক্রম করার সময়টুকু হাইবারনেশনে কাটানোর জন্য নির্ধারিত বক্সে গিয়ে শুয়ে পড়ল। টাইমার সেট করে নিয়েছে সে, যাতে ঠিক দুমাস পর যখন তার যানটি তার লক্ষ্যে গিয়ে পৌছাবে তখন তাকে হাইবারনেশন থেকে উঠিয়ে দেয়।
প্রায় দেড়মাস পর...
কিফর এর হাইবারনেশন টুটে গেছে। কিন্তু এবারের হাইবারনেশনটা ধীরে ধীরে আরামে কেটে যায়নি। বরং প্রচন্ড ব্যাথায় তার শরীর কচকচিয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে প্রায় চিৎকার বেরিয়ে আসছে ব্যাথার অসহ্য যন্ত্রনায়। খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছে অনেকক্ষন ধরে প্রচন্ড জলীয় বাষ্পের মধ্যে অক্সিজেন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে কিফর এর ফুলকাটা। সেই সাথে অভিকর্ষজ ত্বরনে প্রচন্ড গতিতে নিচে নামতে গিয়েই এটি ঘটেছে। ফুসফুস এত উপরে অক্সিজেন খুঁজে না পাওয়ায় ফুলকা-ই তাকে এতক্ষন বাচিয়ে রেখেছে। কিন্তু প্রচন্ড পরিশ্রমে ফুলকাটা বোধহয় এতক্ষনে পুরোই অকেজো হয়ে গেছে। তবে ফুসফুস এখন বেশ আরামেই কাজ করছে। কিফর এই মুহুর্তে যেখানে অবস্থান করছে তার চারপাশে বায়ুমন্ডল রয়েছে, আর সেখানে অক্সিজেনের পরিমানও যথেষ্ট। শরীরের বিভিন্ন জায়গায়ও প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সবচে বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে পাখনাতে। উল্টে ঝুলে থাকা কিফর বেশ কষ্ট করে মাথা ঘুরিয়ে পাখনার দিকে তাকিয়ে রীতিমত ভয়ই পেয়ে গেল। যে পাখনার মাধ্যমে সে এরকম বায়ুমন্ডলে বেশ আরামে উড়তে পারত সেই পাখনার জায়গায় এখন আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। বরং সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। পানিতে ভেসে বেড়ানোও এখন তার পক্ষে অসম্ভব।
চারপাশে তাকিয়ে দেখল কিফর। এখনতো তার মহাকাশযানে থাকার কথা, কিন্তু সেই শক্তিশালি মহাকাশযানটি কোথায়? কোত্থাও দেখা মিললনা। বরং নিজেকে আবিষ্কার করল একটা আজব প্রকৃতির বিশাল, চওড়া গাছের ডালপালার প্রান্তে পা আটকে ঝুলে থাকতে। ছোট্ট একটা টুলবক্স তার শরীরের সাথে পেচিয়ে আছে, আর জামাটাও শতছিন্ন হয়ে আছে। টুলবক্সের ভেতর থেকে কিছু ফার্স্ট এইড নিয়ে রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু পাটা এমনভাবে পেচানো ডালের সাথে লেগে আছে কিছুতেই সোজা হওয়া যাচ্ছেনা। তবে উল্টে থাকলেও অবস্থানটা বেশ নিরাপদ। পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যে গাছটাতে সে ঝুলে আছে সেই গাছটা একটু কেমন যেন ভুতুড়ে। এমন আকারের গাছ সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। গাছটি অনেক উঁচু আর এর দেহও এমন মোটা যে, তা প্রায় বিশাল কোন সুপার মার্কেটের চেয়েও মোটা। আর তার ডালপালা প্রায় একটা বিশাল শহরকে ছায়া দেবার উপযোগী। উচ্চতা কতটুকু তা আন্দাজ করা যাচ্ছেনা, কেননা নিচের দিকে প্রায় দশতলার সমান নিচ থেকে গাছটা তরল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। তরলগুলো ঠিক পানির মত নয়, দেখে খুব দাহ্য কোন জ্বালানী তেলের মত লাগছে। আর পুরো গ্রহটাই বোধহয় এই তরলে ডুবে আছে, কেননা এ গাছটা ছাড়া আর কোন গাছ তার নজরে পড়ছেনা, চোখ যতদুর যায় চোখে পড়ে শুধু সেই বিচিত্র তরল আর তরল। তবে এই তেলতেলে তরলের নিচে যে কোন একটা স্তরে অবশ্যই পানি আছে, নইলে গাছটা বেচে থাকতে পারতনা।
বিরাট গাছটা ছাদের মত কাজ করছে, প্রচন্ড রোদ কাছেই আসতে পারছে না, আবার কিছুক্ষন পরপর তরলের মত কি যেন আকাশ থেকে পড়ছে, তবে তাও গায়ে লাগছেনা। একটু বেকায়দায় থাকলেও নিরাপদ জায়গায়ই রয়েছে কিফর। আস্তে আস্তে খিদে বাড়ছে। হাইবারনেশন ছুটে গেলে সাধারনত সাথে সাথেই প্রচন্ড খিদে লাগার কথা। কিন্তু আকস্মিকতা সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন আর এ খিদে সহ্য করার মত অবস্থা নেই। এমনিতেই যদি গাছ থেকে কোনভাবে পড়ে যায় তবে কিফরের মৃত্যু নিশ্চিত। আবার গাছ থেকে পড়ে না গেলেও ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরেও মরতে হবে। এভাবে কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই দমকা বাতাসে গাছটা ক্ষানিক নড়ে উঠল। আর সাথে সাথে উপর থেকে ফলের মত কি যেন ঝরে পড়তে লাগল। হাত বাড়াতেই কিফরের হাতে ধরা পড়ল বেশ কয়েকটা। মুখে দিয়ে ভালই লাগল। খেতে মিষ্টি আর ক্ষানিকটা নোনতা, আর পানির পরিমান এত বেশি যে ক্ষুধার পাশাপাশি তৃষ্ণাও আর রইল না।
চাতুর প্রানীরা সাধারনত উল্টো ঝুলে ঘুমায়, তাই কিফরের কাছে এই উল্টে ঝুলে থাকাটা কষ্টের নয় বরং বেশ আরামের। কতদিন কিফর যে স্বপ্ন দেখেছে শুধুমাত্র ঝুলে খেয়ে বেচে থাকবে আর তাইতো কতনা পরিশ্রমের কাজ করেছে এতদিন। তার ইচ্ছে ছিল বেশ টাকাকড়ি জমিয়ে শেষ জীবনে আরামসে ঝুলে যাবে, সেই সুযোগটা এতদিনে এসেছে। দিনের পর দিন ঝুলে আছে, খাবারেরও কোন কষ্ট নাই, অক্সিজেনও আছে। আর তার নিজের গ্রহেতো অর্ধেক দিন অক্সিজেন পাওয়া যায়, বাকিটা সময় হয় কিনে নিতে হয়, নইলে পানিতে ডুবে ফুলকার সাহায্যে দম নিতে হয়। আর খাবারের দাম পরিশোধ করাটা তার গ্রহের মূল সমস্যা। খাবার এত দামী যে, একদিন কাজ না করলেও না খেয়ে থাকতে হয়। কিফর এই নতুন স্থানেই বেশ আরামে আছে, অক্সিজেন আনলিমিটেড, খাবারও পায় কিছুক্ষন পর পর। চাতুররা তেমন সামাজিক প্রাণীও নয়, ফলে তার একলা থাকতে কোন কষ্টই হচ্ছেনা।
সুখে থাকলে নাকি সেই সুখ কারো কারো সহ্য হয়না, কিফরেরও সহ্য হলো না। মাসাধিককাল আরামে থাকার পর কেন যেন একটা কথা বারবার কিফরের মনে আসতে লাগল, “যদি কোনদিন ফল পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন কি হবে? এভাবে বন্দী হয়ে থাকার কোন মানে হয়! খাবারের আশায় বসে না থেকে তারচে বরং মুক্ত হয়ে গিয়ে নিজেই খাবার খুঁজে নেব।” ভুত মাথায় চাপল, এখান থেকে মুক্ত হয়ে গিয়ে ঠিক ওপরের কোন একটা ডালে গিয়ে ঝুলে পড়বে। যখন থেকে চিন্তাটা মাথায় এল, ঠিক তখন থেকেই সে দাপাদাপির শুরু করে দিল। যে করেই হোক পা-টা ছাড়াতে হবে। আশপাশে কেমন যেন চিকন চিকন কিছু ডাল আছে সেগুলোকে হাত দিয়ে টেনে এনে তার উপর ভর করে পা-টাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। অনেকক্ষন ঝাড়াঝাড়ি করার পর পা আস্তে আস্তে ঢিলে হলো। কিন্তু প্রচন্ড ক্লান্তি তাকে দুর্বল করে দিল। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কতক্ষন ঘুমিয়েছে সে জানেনা, ঘুম ভাঙল অক্সিজেনের প্রচন্ড অভাব অনুভবের মাধ্যমে। কিফর নিজেকে কম ঘনত্বের তেলের ঠিক নিচে, যেখানটায় পানির স্তরের শুরু হয়েছে ঠিক সেখানে আবিষ্কার করল। অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাস যখন তাকে পুরোই দখল করে নিয়েছে তখনো সে বুঝতে পারল যে, সে গাছ থেকে পড়ে গেছে। এখন তার আর কিছুই করার নেই, এখানে সাতার কাটা সম্ভব নয়, আর ফুলকা তো আগেই গেছে। ধ্বংশ অবধারিত।
মাসখানেক আগে এ গ্রহে কিফরের আগমনের মাধ্যমে একমাত্র প্রানীর উদ্ভব ঘটেছিল। এ গ্রহের একটি মাত্র গাছই এই কিফরকে তার জীবনকাল অব্দি বাচিয়ে রাখতে পারত, কিন্তু কিফর ছিল বড়ই অস্থির। তার অস্থিরতা, অবিশ্বাস আর সীমা অতিক্রমের জন্য উদগ্রীবতা এ গ্রহকে আবারও “জীবিত প্রানি”হীন গ্রহে পরিণত করে দিয়েছে।
No comments:
Post a Comment