Tuesday, May 26, 2015

মালেশিয়া ভ্রমন - ২: প্রস্থান (শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর)

Shahjalal International Airport ( Photo Credit: Nahid Sultan )
আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে খুব কাছেই ঢাকার একমাত্র বিমান বন্দর। জীবনে প্রথমবারের মত কবে যে সেই বিমান বন্দরে গিয়েছিলাম সময়টা মনে করতে পারছিনা। ছোটবেলা থেকেই অনেক বার আমাকে সেখানে যেতে হয়েছে। তবে কখনোই বিমানে চড়ার জন্যে নয় বরং গ্রাম থেকে আসা আত্নীয়দের কে "বিমান বন্দর" জিনিসটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে কিংবা তাদের বিদেশ যাবার সময় তাদেরকে এগিয়ে দেবার জন্যে বারবার সেখানে গিয়েছি।

২০১৩ সালে নেপাল যাবার সময় প্রথমবারের মত বিমান বন্দরটিকে সত্যিকার ভাবে উপভোগ করেছি। আমাদের এই বিমান বন্দরটা মাঝারি সাইজের একটা বিমান বন্দর, দুইটা আন্তর্জাতিক টারমিনাল আছে এখানে, আরেকটা ডোমেস্টিক টারমিনাল আছে। দ্বিতীয় টারমিনাল ভবনটি অপেক্ষাকৃত নতুন, কয়েক বছর আগে এটি তৈরী হয়েছে এবং নতুন আরো একটি টারমিনালের কাজ শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। ১৯৮০ সাল থেকে পুরোদমে চালু হওয়া এই এয়ারপোর্টের নামকরন হয়েছিলো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে। তাঁর নামানুসারে বন্দরের নাম ছিলো "জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর"। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নামকরনের রাজনীতির চাপে পড়ে প্রায় চৌদ্দশ কোটি টাকা খরচ করে এর নতুন নামকরন হয়েছে। বাংলাদেশ অঞ্চলের অন্যতম ধর্মপ্রচারক শাহজালাল (রহ:) এর নামে বিমান বন্দরের নতুন নাম হয়েছে "শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর"।

মালেশিয়া যাবার জন্যে "মালিন্দো এয়ার" এর টিকেট কেটেছি। এটি সবচে কম খরচে যাত্রীদেরকে কুয়ালা লামপুর পৌছে দেয়। প্রথমবার মালেশিয়া যাবার জন্যে এটি একটি ভুল পছন্দ ছিলো। প্রথমবার মালেশিয়া যাবার সময় "বিমান বাংলাদেশ" অথবা "মালেশিয়ান এয়ার" এর টিকেট কাটা উচিত। এ দুটি বিমান KLIA 1 এ নামে, এটি মালেশিয়ার পুরোন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, আন্তর্জাতিক যাত্রীদের ব্যাপারে তারা আগে থেকেই অভ্যস্ত, যাত্রীর জন্যে ঝামেলা কম। অপরদিকে মালিন্দো নামে KLIA 2 তে, এই বিমান বন্দরটি মালেশিয়ার ডোমেস্টিক বন্দর হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, আন্তর্জাতিক যাত্রীদের ব্যপারে তাদের অভিজ্ঞতা কম হওয়ায় অনেক যাত্রীই বেশ ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন। তবে, আপনার মালেশিয়ায় যাওয়ার কারনটি যদি যৌক্তিক হয়, আর আপনি যদি কনফিডেন্ট থাকেন তবে প্রথমবার ভ্রমনে এটা কোন সমস্যাই না। অল্প বাজেটে ভ্রমনের স্বার্থে অভিজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করেই মালিন্দোর টিকেট কিনে ফেলেছিলাম।

মালিন্দোর বিমানটি ছাড়ে রাত ১১ টার সময়। প্লেন ছাড়ার কমপক্ষে আধঘন্টা আগে আপনাকে চেক ইন করতে হবে, এবং লাগেজ চেকইন করাতে হবে (যদি থাকে)। তবে চেকইন শুরু হয় যাত্রার তিনঘন্টা আগে থেকেই। ঢাকার যেই ট্রাফিক জ্যাম কন্ডিশন তাতে যাত্রার সময়ের কমপক্ষে তিনঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হওয়া উচিত। যদিও রাত নয়টার পর রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে আর আমার বাসাও বন্দর থেকে খুব বেশি দুরে নয়, তাই একটু দেরী করে বেরুলেও আমার জন্যে সমস্যা হতো না। তারপরও একলা একলা প্লেনে ভ্রমন এটিই প্রথম, তাই কোন রিস্ক নিতে চাইলাম না, একটু আগে আগেই বেরিয়ে গেলাম। সাড়ে আটটা নাগাদ বিমান বন্দরে পৌছে যেতে পেরেছি।

অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার ট্যুরিস্ট বন্ধুরা ডিএসএলআর ক্যামেরা সংক্রান্ত একটা চমতকার পরামর্শ দিয়েছিলো। আপনি যদি ডিএসএলআর ক্যামেরা সাথে নিয়ে ভ্রমনে যান তবে এ তথ্যটি আপনার কাজে লাগবে। ডিএসএলআর যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই প্রফেশনাল ক্যামেরা হিসেবে ব্যবহার করেন। সে হিসেবে মালেশিয়া থেকে ফেরার সময় এ ধরনের ক্যামেরার জন্যে আমদানী শুল্ক দিতে হয় যদি তা দেশের বাইরে থেকে কেনা হয়। অতএব, আপনি যদি সাথে করে ডিএসএলআর নিয়ে যেতে চান তবে সাথে যথেষ্ট প্রমানপত্র রাখতে হবে যাতে প্রমান করতে পারেন এটি বাংলাদেশ থেকেই কেনা হয়েছে, কিংবা এটি আপনার ব্যবহার করা পুরোনো ক্যামেরা। তাহলে ফেরত আসার সময় এর জন্যে নতুন করে আবার শুল্ক দিতে হবে না। ক্যামেরাটি যদি দেশ থেকে কেনা হয়, তবে কেনার সময়কার রিসিপ্টটি সাথে রাখতে পারেন। রিসিপ্ট না থাকলে সেক্ষেত্রে বিমান বন্দরে প্লেনের চেকইন করার আগেই নিচ তলার শুল্ক কাউন্টার থেকে ক্যামেরাটির জন্যে পাসপোর্টে একটি ডিক্লেয়ারেশন নিয়ে নিতে পারেন। সেটি দেখালে ফেরত আসার সময় আপনার ক্যামেরার জন্যে শুল্ক বিভাগ আর কোন ধরনের চার্জ করবে না। তবে আপনার ক্যামেরাটি যদি যথেষ্ট পুরোন হয় (১-২ বছরের ব্যবহৃত), অথবা সেটি সাধারন ডিজিটাল ক্যামেরা হয় তাহলে ক্যামেরা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও দেশের বাইরে থেকে নতুন কিনলেও ক্যামেরাটি যদি বিক্রি করার উদ্দেশ্যে না কিনে আপনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে নিয়ে আসেন সেক্ষেত্রেও হয়তো আপনাকে শুল্ক দিতে হবে না। তবে যেটি করতে হবে, সেটি হলো ক্যামেরাটি বাক্স থেকে খুলে নিয়ে সাধারন ক্যামেরা ব্যগে নিয়ে আসতে হবে।

বন্দরের টারমিনাল -২ এ ঢুকে মালিন্দোয় চেকইন করে, ব্যাকপ্যাকে একটা স্টিকার (হ্যান্ড লাগেজ) লাগিয়ে নিয়ে ইমিগ্রেশনের জন্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। অভিজ্ঞদের মতানুসারে ইমিগ্রেশন খুবই ভয়ংকর জায়গা, তাঁদের মতে ইমিগ্রেশন অফিসাররা খুবই খারাপ এবং তারা যেকোন সময় যেকোন ধরনের ঝামেলায় ফেলে দিতে পারে। অভিজ্ঞদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এখনকার ইমিগ্রেশন সিস্টেমটা আগের মত আর ভয়াবহ নেই। এম্বারকেশন কার্ড পুরন করে নির্দিষ্ট লাইনে দাড়িয়ে গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। লম্বা লাইন ম্যানেজ করার জন্যে যথেষ্ট পরিমান লোকবল রয়েছে বন্দরের। সেই সাথে একজন সুপারভাইজার থাকেন যিনি আপনাকে তথ্য দিয়ে সব ধরনের সাহায্য করবেন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কম্পিউটারে আপনার ডিজিটাল পাসপোর্টটি স্ক্যান করে আর ফেস রিকগনিশন সফটওয়ার দিয়ে খুব দ্রুত আপনার তথ্য যাচাই করে ছেড়ে দেবেন। দুবারের অভিজ্ঞতায় আমার কখনোই হয়রানীমূলক কোন কিছু চোখে পড়ে নি।

ইমিগ্রেশন পার করে এবার প্লেনে উঠার পালা। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচন্ড রকমের উচ্চতাভীতিওলা মানুষ। পার্কে গিয়ে উচ্চতার ভয়ে কখনো রোলার কোস্টারে উঠিনি। পাঁচতলা বাসার বারান্দায় পর্যন্ত যেতে ভয় লাগে। আকাশে যখন প্লেন উড়তে দেখি তখন নিচে থেকে প্লেনের উচ্চতা চিন্তা করে ভয় পেয়ে যাই। আর প্লেনের ভিতর বসে এত উপরে দিয়ে এতদুর উড়ে যাব ভাবতে পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। এশার নামাজ পড়ে খানিকটা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বিমান বন্দরের অন্য যাত্রীদের সাথে আলাপ করে প্লেনের কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে প্লেনে উঠে পড়লাম। যা থাকে কপালে।

প্লেনে উঠার আগেই আমি সাধারনত প্রাকৃতিক আবেদনগুলোর একটা ব্যবস্থা করে নেই। যদিও প্লেনে ভাল টয়লেট আছে, কিন্তু তারপরও প্লেনের ভেতর হেটে হেটে টয়লেটে যাওয়ার মত সাহস আমার নাই। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর মাত্র চার ঘন্টার পথ, নিজেকে ফ্রি করে নিয়ে প্লেনে উঠে পড়লে এ সংক্রান্ত ঝামেলার আর কোন অবকাশ থাকার কথা নয়। কুয়ালা লামপুরে যাওয়া মানুষের প্রকারভেদ অনেক। অনেক ধরনের মানুষ অনেক অনেক কারনে কুয়ালা লামপুর যায়। নেপালের মত শুধু মাত্র ভ্রমনকারী টাইপে লোক নয়, বরং এবারে প্লেনে হরেক রকমের মানুষ দেখলাম। হরেক রকমের মানু্ষ থাকলেও যে যার মত বসে থাকলে তাদের নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্য রকমের দু ধরনের মানুষ দেখতে পেলাম এ যাত্রায়। না চাইলেও বারবার এরা নজরে চলে আসছিলো। এদের মধ্যে একটি ধরন হল বেয়াড়া প্রজাতির মানুষ, আর আরেকটি হলো মনোযোগ প্রত্যাশী নার্ভাস মানুষ।

বেয়াড়া প্রজাতির মানুষগুলোকে শতবার মানা করার স্বত্ত্বেও তারা তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ তো দুরের কথা, অনর্গল ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলো। টেকঅফের সময় সাধারনত সাথে থাকা মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়ার জন্যে ঘোষনা দেয়া হয়, এবং এটেন্ডেন্সরা প্রত্যেকটি সারিতে দাড়িয়ে ফোন বন্ধের ব্যপারটি নিশ্চিত করেন। কিন্তু দুতিনজন মানুষ পাওয়া গেল যাদেরকে বারবার অ্যাটেন্ডেন্স এসে রিকোয়েস্ট করার পরও ফোনে কথা বলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। দুয়েকবার তো তাঁরা এসে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ফোন বন্ধ হওয়া নিশ্চিত করে গেলো, তারপরও এই বেয়াড়া লোকগুলো ঠিকই আবার ফোন চালু করে পুনরায় ফোন করে কথা শুরু করেছে।

প্রত্যেক প্লেন জার্নিতে আপনি কমপক্ষে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে পাবেন যারা প্লেনে প্রকৃতির ছোটখাট প্রত্যেকটি ডাকে সাড়া দেবার জন্যে বারবার টয়লেটের দিকে ছুটতে থাকবে। মালেশিয়া ভ্রমনে মোট ছয়বার প্লেনে উঠে বেয়াড়া লোক সব সময় না পেলেও এই প্রকৃতিপ্রেমীদেরকে সবসময়ই পেয়েছি। লুজ মোশন কিংবা ব্লাডার সমস্যার কারনে যদি তারা ঐ দুর্গতির মধ্যে পড়ে গিয়ে থাকেন তাহলে তা অত্যন্ত দু:খজনক, কিন্ত নার্ভাসনেস যদি ঐ অবস্থার মূল কারন হয় তবে তা আরো বেশি দু:খজনক। যাহোক, একজন নারীকে দেখলাম উনি প্রত্যেকবার টয়লেটে যাবার সময়া সবার নজর আকর্ষন করে এমনভাবে হেসে হেসে হেটে যাচ্ছিলেন যেটা দেখে মনে হচ্ছিলো কোন রকস্টার যেন স্টেজে উঠছেন। চারঘন্টার ভ্রমন বেয়াড়া আর প্রকৃতিপ্রেমীদের আচরন দেখে দেখে ভালই কেটেছে।

রাতের বেলার এই প্লেন ভ্রমনে আরো দুটো আশ্চর্য জিনিস আমাকে জাগিয়ে রেখেছিলো। সেগুলো হল "চাঁদ" আর "বিজলী"। প্লেনের ডানার পাশ দিয়ে চাঁদটি এমভাবে ঝুলে ছিলো যেন মনে হচ্ছিলো আমি চাঁদের উচ্চতায় পৌছে গেছি আর চাঁদটা আমার পাশে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আর চাঁদের আলোয় নিচে গাঁঢ় ছাই রঙের মেঘ দেখেছি, সেই মেঘের ঘর্ষনে তৈরী হওয়া বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্যও দেখেছি। আজীবন বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্য দেখার জন্যে উপরের দিকে তাকাতে হয়েছে, আর এই প্রথমবারের মত জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুত চমকানোর দৃশ্য দেখলাম। চাঁদ আর বিদ্যুত চমকানো দেখতে দেখতে কখন যে চার ঘন্টা পার হয়ে গেলো আর কুয়ালালামপুরে পৌছে গেলাম তা বুঝতেই পারলাম না।

No comments: