KLIA2 plane ground |
কুয়ালালামপুরে যখন পৌছলাম তখন স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা। রাত জাগা আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ, তবু পুরো ফ্লাইটের সময়টায় জেগে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঢুলু ঢুলু চোখে প্লেন থেকে নেমে ভারী ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে সিড়ি দিয়ে এরাইভাল হল এসে পৌছলাম। অনাকাঙ্খিত ভাবে সেখানে চার পাঁচ জনের একটা ইমিগ্রেশন পুলিশের দলকে কড়া মুখ-চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমাদের ফ্লাইটের প্রত্যেক যাত্রীকে পথ আগলে পাসপোর্ট চেক করতে শুরু করলো। যারা প্রথমবারের মত মালেশিয়ায় এসেছে তাদের পাসপোর্টটা রেখে দিয়ে সবাইকে একপাশে লাইন করে দাড় করিয়ে দিলো। স্বাভাবিকভাবে আমিও এদের দলে পড়ে গেলাম, আর আশু মহাঝামেলার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ভীনদেশী পর্যটকরা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো তখন এই জনা পঞ্চাশেক নারী-পুরুষ-শিশুকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হচ্ছিলো। বিদেশ ভ্রমনে বের হলে প্রথম প্রথম অবশ্যই মনে হবে যে, বাংলাদেশী হয়ে জন্মানোটা কতটা অসম্মানজনক। যদিও আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই অসম্মানজনক জীবনের জন্যে আমরা দায়ী নই, বরং আমাদের নেতারাই দায়ী। মালেশিয়া, ইউএসএ কিংবা ইউকে তে গেলে আপনি দেখতে পাবেন দেশের সম্পদ চুরি করে এদেশের মন্ত্রী-এমপি আর আমলা কি পরিমান সম্পদ জমা করেছে। আমাদের সম্পদ আমাদের মধ্যে সমান / যৌক্তিকভাবে বন্টন না করে নিজেরা খেয়ে দেয়ে ফুলে ফেঁপে গিয়েছে। বাংলাদেশের এম্বাসীগুলো প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীদের কে সামান্য সহায়তা তো দুরে থাক পারলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। যে দেশের মানুষ তাদের নেতা আর আমলাদের কাছ থেকেই অত্যাচারের শিকার হয়, সেদেশের মানুষের প্রতি অন্য কোন দেশ কখনোই সম্মান দেখাবে না।
১. টয়লেট: Tandas
২. নামাজের জায়গা: Surau
৩. বাহির: Keluar
Shaheed at KLIA2 |
KLIA2 একটা বেশ বড় এয়ারপোর্ট। এর তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশটিকে বলা হয় "ট্রান্সপোর্টেশন হাব", চারতলা বিশিষ্ট এই অংশ রয়েছে কার পার্কিং, বাস ট্রান্সপোর্ট, ট্রেইন ট্রান্সপো্র্ট (KLIA Express) এবং রাত্রী যাপনের জন্যে হোটেল। দ্বিতীয় অংশটিকে বলা হয় "গেটওয়ে", এখানে পাবেন দেশি বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের পোষাক, ইলেক্ট্রনিক্স পন্য, চকলেট, খাবার দোকান ইত্যাদি। মালেশিয়ায় শপিংএ এলে ভুলে কেনেননি এমন জিনিসগুলো এখান থেকে কিনে নিতে পারবেন। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে গেটওয়েতে ঢুকতেই মোবাইল ফোনের সিম কার্ড ও রিচার্জ করে নেবার দোকান পেয়ে যাবেন। বন্দরের তৃতীয় অংশটির নাম হলো "টারমিনাল", এরাইভাল, ডিপার্চার ও ইমিগ্রেশন সবকিছু মিলে টারমিনাল বিল্ডিং।
সময় হাতে আছে, তাই এয়ারপোর্ট টা বেশ আয়েশ করে কয়েকবার ঘুরে দেখলাম। রাতে না ঘুমানোয় একটুখানি ক্লান্তি লাগছিলো, আর সকাল বেলা ক্ষুধাটাও একটুখানি দুর্বল করে দিচ্ছিলো। একলা একলা রেস্টুরেন্টে যাবার অভিজ্ঞতা আমার নেই বললেই চলে, সত্যি বলতে খাবার কেমন করে অর্ডার করতে হয় সে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। বন্ধুদের মতে বিদেশ গেলে আমি শুধুমাত্র খাবার কিনতে না পেরে ক্ষুধায় মারা যাবো। ওদের সকলের ভবিষ্যদ্বানীকে ভুল প্রমান করে একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার করে ফেললাম। আন্দাজে ছবি দেখিয়ে একটা খাবারের অর্ডার করেছি, খাবার যেটা আসলো সেটা দেখে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। ছোট্ট একটা কি যেন দিলো, আর এত্তোগুলো টাকা নিয়ে গেলো। খেয়ে যে কিছুতেই পেট ভরবে না তাতে শিওর হয়ে আস্তে আস্তে খেতে লাগলাম।
বিমান বন্দর থেকে কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার প্রায় ৫৫-৬০ কি.মি. দুরে। বন্দরের ট্রান্সপোর্টেশন হাব থেকে পছন্দ মত যেকোন একটি বাহনে করে আপনি শহরের কেন্দ্রে পৌছে যেতে পারেন। সবচে দ্রুতগামী বাহন হলো ট্রেন যা "KLIA Express" নামে পরিচিত। এটি মাত্র ২৮ মিনিটে আপনাকে পৌছে দেবে "KL Sentral" (শহরের কেন্দ্রে) এ। এ পরিবহনে আপনার খরচ হবে প্রায় ৩৫ রিঙ্গিত। এছাড়া আছে ট্যাক্সি, যা সবচে খরচবহুল পরিবহন। আপনি যদি নিজে ড্রাইভ করতে পারেন তবে বন্দরের নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে "এয়ার এশিয়া"র রেন্ট-এ-কার সার্ভিস থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ৬, ১২ ঘন্টা বা ২৪ ঘন্টার জন্যে আপনি খুব সস্তায় গাড়ি ভাড়া করতে পারবেন। যদি জরুরি কাজ সেরে ঐদিন বা তার পরদিন বিমান বন্দরে ফেরত আসার পরিকল্পনা থাকে শুধু সেক্ষেত্রেই এই পরিবহন ব্যবস্থাটি আপনি গ্রহন করতে পারেন। এছাড়া সবচে কম খরচের পরিবহন ব্যবস্থা হল বাস। বাস ভাড়া প্রতি জনের জন্যে ১০ রিঙ্গিত, রাউন্ডট্রিপ ভাড়া মাত্র ১৬ রিঙ্গিত। বাসে সময় লাগবে ১ ঘন্টার কিছুটা কম। বন্দরের সবচে নিচ তলায় বাসের টিকেট কাটা যায়, সেখানকার গেট দিয়ে বেরুলেই বাসকে অপেক্ষমান দেখতে পাওয়া যাবে। ২৪ ঘন্টাই এ সার্ভিস চালু থাকে, প্রতি ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে বন্দর থেকে।
বাস স্টেষন, KLIA2 |
KL Sentral জায়গাটা অনেকটা আমাদের ফার্মগেট কিংবা গুলিস্তানের আধুনিক ভার্সন। এখান থেকে কুয়ালা লামপুর বা মালেশিয়ার যেকোন জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের কেন্দ্রীয় স্টেষন এটি, এখান থেকেই সব গাড়ি, ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যের দিকে চলে যায়। বিমান বন্দরের মত এটিও অনেকগুলো তলায় ও অংশে বিভক্ত। বিভিন্ন তলায়, বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের স্টপেজ ও টিকেট কাউন্টার রয়েছে। আর মাঝে পুরোটা একটা বহুতল মার্কেট, এখানেও বিভিন্ন ব্রান্ডের খাবার দাবার ও পোষাক আষাকের দোকান রয়েছে।
Adnan at KL Sentral |
আমি যেমন তেমন টাইপ একটু নাস্তা করলেও আদনানের নাস্তা করা হয়নি। তাই KL Sentral এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে গেলাম যেখানে অনেক ব্রান্ডের খাবার দাবার পাওয়া যায়। ম্যাকডোনাল্ডস এর হ্যাপি আউয়ার ধরার টার্গেট নিয়ৈ সেখানে ঢুকে পড়লাম, বার্গার আর কফি দিয়ে সকালের নাস্তাটা শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হলো।
আজকের দিনের জন্যে আসলে আমার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। সন্ধায় বন্ধুরা কুচিং থেকে এসে পৌছাবে। সারাটা দিন কোন রকমে পার করে দিতে পারলেই বাঁচি। আদনানের জরুরী কাজগুলোয় সঙ্গী হবো, দুপুরে হোটেলে চেকইন করে একটা ঘুম দেব এটাই আপাতত পরিকল্পনা। আদনানকে Ampang Park এ একটা ট্রাভেল এজেন্সীর অফিসে যেতে হবে। KL Sentral থেকে LRT (রেল ট্রান্সপোর্ট) এ করে সেখানে যাওয়া যাবে। স্বয়ংক্রিয় কাউন্টার থেকে LRT এর টোকেন কিনতে পাওয়া যায়। ATM মেশিনের মত যন্ত্রটিতে আপনি টাকার নোট একটা একটা করে ঢুকিয়ে দিতে হয়, নির্ধারিত ভাড়া টুকু রেখে সে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে দেবে, আর সাথে দেবে একটা টোকেন।
এই টোকেনটি মেশিন রিডেেবল, LRT এর প্লাটফরম এ ঢোকার সময় গেটে এটি স্ক্যান করে প্রবেশ করতে হয়, আবার যে জায়গায় যাবার জন্যে টোকেনটি নেয়া হয়েছে ঠিক সেই জায়গার প্লাটফরমের বের হওয়ার গেটে এটি স্কান করেই কেবল বের হওয়া যাবে। অন্য কোন স্টেশনে স্ক্যান করা হলে তাতে গেইটের দরজা খুলবে না। LRT তে বসার কোন ব্যবস্থা নেই। সব যাত্রীকেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভ্রমন করতে হয়।
Inside LRT |
Jalan Ampang, Kuala Lumpur |
আদনানের কাজ শেষ হবার পর বুকিত-বিনতাংয়ে চলে এলাম, সেখানে আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে আদনান চলে গেল। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুতেই ঘুম চলে এল। বিকেলের দিকে আদনানের ফোনে ঘুম ভাঙলো, হোটেল থেকে বেরিয়ে আদনানের সাথে একসাথে একটা বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে ভাত খেলাম, তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে আবার এক ঘুম। সন্ধায় ঘুম থেকে উঠে মাগরিবের নামাজ পড়ে কম্পিউটার নিয়ে বসতে না বসতেই কুচিংয়ের বন্ধুরা হাজির হয়ে গেল।
এশার নামাজের পর রাতের খাবার আর হাটাহাটির জন্যে বের হলাম সবাই। বের হতেই দেখি বৃষ্টি পড়ছে। কুয়ালা লামপুরে সাধারনত প্রতিদিনই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয়ই। এখানকার বৃষ্টির ধরন হলো এখানে ঝপঝপ করে বৃষ্টি তেমন হয়না, বরং ঝিরিঝিরি করে অনেকক্ষন বৃষ্টি হয়ে আস্তে আস্তে থেমে যায়। দিনে, সন্ধায় কিংবা রাতে কোন না কোন এক সময় বৃষ্টি হবেই। বুকিত বিনতাং এর রাস্তার পাশে তুর্কী একটা রেস্টুরেন্টে রাতে খাবার খাওয়া হলো।
তুর্কি রেস্তোঁরার খাবার দাবার |
রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বেরোই তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো। বুকিত বিনতাং থেকে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার খুব কাছেই। হেটে দশ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌছে যাওয়া যায়। বৃষ্টির কারনে ট্যাক্সি নেয়া হলো, এখানকার রাস্তাগুলো বেশিরভাগ একমুখী হওয়ায় অনেকটা ঘুরে সেখানে যেতে হলো। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের নিচ তলায় একটা মার্কেট রয়েছে, "Suria KLCC" এর ভেতর খানিকটা ঘোরাঘুরি করে টাওয়ারের চত্বরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখনো বৃষ্টি পড়ছিলো। আকাশে মেঘ আর চারপাশের উঁচু বিল্ডিংগুলো মিলে চমতার একটা ল্যান্ডস্কেইপ তৈরি হয়েছে। এ যেন ইট-পাথরের কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য।
পেট্রেনাস টুইন টাওয়ার অনেক দিন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচে উঁচু বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত ছিলো। জীবনে প্রথমবারের মত শ'য়ের বেশি তলার কোন বিল্ডিং দেখলাম। যদিও বৃষ্টি আর মেঘের জন্যে ভাল ভাবে দেখতে পারছিলাম না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, পোস্টার আর ছবিতে দেখা এই জাদুকরী বিল্ডিং আমি নিজ চোখে দেখছি, হাত দিয়ে ছুয়ে দেখছি, আর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছি।
|
Jalan Ampang এর রাস্তায় প্রায় আরো একঘণ্টা হাঁটাহাঁটি শেষে হোটেলে ফিরে গেলাম। তারপর ঘুম।
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের প্রবেশ পথে, ছবিতে বাঁ দিক হতে- মুনতাসীর রশিদ, শাহিদ, ইমরান ও সিয়াম |