সাহেব আলী ঘর বানাবেন। নিজের ঘর। তাই মনটা তার খুবই ভাল। ভাল মানে বেশ ভাল। আসলে অনেক ভাল। বুঝানো যাবে না তার মন সত্যিকার অর্থে কতখানি ভাল। ঘর, সাহেব আলির একটা স্বপ্নের বস্তু। নতুন, ঝকঝকে-তকতকে শক্ত-পোক্ত একটা ঘরের কথা সে অনেকদিন ধরে কল্পনা করেছে। অনেকদিন মানে সেও প্রায় ৩০-৩৫ বছরের লম্বা সময়। ভাবতে গেলে মনের চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়। আর চোখও কেমন ঝাপসা হয়ে যায়। পানিভরা চোখটা মুছে নিতে হয়। সাহেব আলী গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে সে বহুদিন আগের কথা। তাদের গ্রামে তখন দূর্ভিক্ষ চলছিল। একইসাথে চলছিল নদীতে ভাঙনও। দূর্ভিক্ষে ওর মা মরে গিয়েছিল, বাপও প্রায় যায় আর একদিন হঠাৎই সর্বনাশা নদী ওদের বাড়িটা গিলে ফেলল। ছোট্ট ভিটে ছাড়া যদিও ওদের তেমন কিছু ছিল না, তারপরও সারাদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে, কাজকর্ম শেষ করে ঐ নিজেদের ছোট্ট ঘরখানিতেই ছিল ওদের পরিবারের আনন্দের প্রবাহ। গন্ডগোলের দিন শেষ হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হল, আর স্বাধীনচেতা নদী তাদের এই আনন্দ কেড়ে নিল। ঘর হারানোর সপ্তাহখানেক বাদেই সাহবে আলী হারালো তার প্রিয় বাপজান, স্নেহময়ী বড়বুবু আর স্নেহের ছোটভাইটাকে। মাতো আগেই গেছে। তারপর ১০ বছরের সাহেব আলী শহরের দিকে পা বাড়াল। লাল-নীল বাতির শক্তমনের মানুষদের শহরে এসেই আক্রান্ত হতে হল টাইফয়েডে। আল্লার সাহায্যেই কোন হৃদয়বান মানুষ সাহেব আলীকে হাসপাতালে দিয়ে এসেছিল ফুটপাত থেকে তুলে। টাইফয়েডে তার একটা হাত আর একটা পা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও সে যাত্রায় প্রাণটা তার শরীরের সাথে রয়েই গেল।
পুরোনো কথা ভাবতে সাহেব আলীর ভাল লাগে না। অনেক কষ্টের স্মৃতিগুলো হাতড়াতে গেলে হয়রান লাগে তার। আর সে ঐ পুরোনো স্মৃতি আগলে রাখতে চায়না। কি হবে কষ্টের কথা ভেবে। আজ তার অনেক আনন্দের দিন। আজ তার নিজের একটা ঘর হবে। আজ তার অনেক আনন্দ। তবে আজ সারাদিন তাকে অনেক কিছু করতে হবে। ঘরের কাজ বেশ খানিকটা বাকি আছে। বাকি রসদ কিনে এনে সম্পুর্ন কাজ শেষ করতে হবে। পকেটে টাকাপয়সা যথেষ্ট পরিমান নিয়ে ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে রাস্তায় নামল সাহেব আলী। প্রথমে যেতে হবে বড় ছেলে আজম আলীর কাছে। বড় ছেলে রেলে চাকরী করে। তার কাছ থেকে কিছু টাকা পেলে হয়তো ঘরটা আরো মজবুত করে বানানো যাবে। তবে সাহেব আলীর এ ছেলেটার কাছ থেকে টাকা পাবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। ছেলেটা বড় হয়ে কেমন জানি হয়ে গেছে। ছোট থাকতেই বাপমার কথা শুনতে পছন্দ করত না, আর রেলে চাকরী হবার পর বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। থাকেও অন্য শহরে। তবে ওর রেল প্রতিদিন দুবার ঢাকা আসে। সকাল আটটায় কমলাপুর রেল-স্টেশনে গেলে আজম আলীকে পাওয়া যায়। হেঁটে হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিল সাহেব আলী। তার পিছন পিছন হাটছে তার ছোট ছেলে। ওর এ ছেলেটা খুব ভাল। বাপমার সাথে থাকে, বাপমার সেবাযত্ন করে। এই বয়সেই দেশের মানুষের উপকারে মন দিয়েছে সে। দেশের শিক্ষা উন্নয়নে ওর ভূমিকা কিন্তু খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ওর মত আরো অনেকের সাহায্যেই কাগজ কারখানা গুলো কম দামে কাঁচামাল পেয়ে থাকে। তৈরী করে কম খরচে কেনার মত কাগজ আর খাতা। সেই কাগজ আর খাতা দিয়ে কত শিশু পড়াশুনা করছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু দু:খের ব্যপার এই যে, ছোট ছেলে করম আলিকে সাহেব আলী পড়াশুনা করাতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment